Exploring Social Significance Of Jamai Shasthi Bengali tradition

Exploring Social Significance Of Jamai Shasthi Bengali tradition

Exploring Social Significance Of Jamai Shasthi Bengali tradition

 

Featured

জামাই ষষ্ঠী: ইতিহাস, অর্থ এবং সংস্কৃতিতে এর গুরুত্ব

বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর মধ্যে জামাই ষষ্ঠী একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। জামাই ষষ্ঠী শুধু একটি লোকাচার নয়, এটি মা ষষ্ঠীর পূজার সঙ্গে যুক্ত একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। এই ব্লগে আমরা জামাই ষষ্ঠীর ইতিহাস, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, এবং বাংলার পারিবারিক জীবনে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

বিষয়বস্তুসূচী

Step 1: জামাই শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ ও ইতিহাস 📜

অথর্ববেদে ‘জামি’ শব্দটি বোনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পণ্ডিত সায়নাচার্য অথর্ববেদের ভাষ্যে জামি শব্দের অর্থ বোন হলেও তা কন্যা বা বৌদীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, সম্মানীয় যেকোনো মহিলাকে জামি বলা যেতে পারে। অন্যদিকে, ‘জামাত্রী’ শব্দের অর্থ জামাই। এটি কখনো কখনো স্বামী বা শালক অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে।

শিবপুরাণ অনুযায়ী, নারদ মুনিকে শিবের বিয়েতে গোত্র জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। শিবের গোত্র কি? কারণ তিনি স্বয়ম্ভু। নারদ মুনি পার্বতীর বাবাকে জানান, শিব সুগোত্র। শিব পুরাণ, মহাভারত এবং যাজ্ঞবল্ক সংহীতাতেও ‘জামাত্রী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

শিবের বিয়েতে গোত্র জিজ্ঞাসা

তবে জামাই ষষ্ঠী একটি লোকাচার, যা শাস্ত্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। বাংলা ছাড়িয়ে অন্যান্য রাজ্যেও মা ষষ্ঠীর পূজা বিভিন্ন নামে প্রচলিত আছে, কিন্তু জামাই ষষ্ঠী মূলত বাংলার লোকাচার। এটি অরণ্য ষষ্ঠির সঙ্গে যুক্ত হয়ে জামাইর নিমন্ত্রণের রূপ নিয়েছে।

Step 2: মা ষষ্ঠী দেবীর পূজা ও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব 🙏

অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, ষষ্ঠী দেবী প্রজনন এবং শিশুর রক্ষা কর্ত্রী। শিশুকে রক্ষা করেন তিনি। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, সিন্ধু সভ্যতাতেও এমন দেবীর পূজা হতো, যদিও ষষ্ঠীর নাম ছিল না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, ষষ্ঠী দেবীর পূজায় মৃত সন্তানদের জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কথাও রয়েছে।

বাংলায় মা ষষ্ঠীর পূজা প্রতি মাসেই শুক্লা ষষ্ঠীতে হয়, তবে বিশেষ করে জৈষ্ঠ মাসের অরণ্য ষষ্ঠি বা জামাই ষষ্ঠী বড়ো উৎসব হিসেবে পালিত হয়। মা ষষ্ঠীকে সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট চেহারা দেওয়া হয়নি। মাটির বটগাছের ডাল বা পিটুলির মূর্তি দিয়ে তার আরাধনা করা হয়। মন্ত্রে তিনি ফর্সা গায়ের, দু হাতে অস্ত্র ও কোলে শিশুপুত্রসহ কালো বেড়াল বাহন করে বর্ণিত।

পৌরাণিক কালে বেড়ালকে প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হতো, কারণ বেড়ালের বাচ্চার সংখ্যা বেশি। তাই বেড়ালকে মা ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে ধরা হয়।

মা ষষ্ঠী দেবী এবং কালো বেড়াল

Step 3: ষষ্ঠী পূজার লোকগল্প ও সামাজিক প্রেক্ষাপট 📖

একটি জনপ্রিয় লোকগল্পে বলা হয়, এক বনিক বাড়ির ছোট বউ খুব লোভী ছিল, বিশেষ করে খাবারের প্রতি। ষষ্ঠী পূজোর দিনে অতিথিরা চলে যাওয়ার পর সে মিষ্টি খেয়ে ফেলে এবং বেড়ালকে দোষ দেয়। বেড়াল রেগে গিয়ে তার সাতটি সন্তান একে একে নিয়ে বনে চলে যায়। বউ তখন দুঃখে বনে ঘুরে বেড়ায়। মা ষষ্ঠী ছদ্মবেশে এসে তাকে বুঝিয়ে দেন, এবং বউ ক্ষমা চেয়ে ষষ্ঠী পূজা করে সন্তানদের ফিরে পায়।

এই গল্পটি উপাখ্যান হলেও, মা ষষ্ঠীর পূজার সামাজিক-নৈতিক শিক্ষাকে তুলে ধরে। এটি বাঙালির মধ্যে পারিবারিক বন্ধন এবং সন্তানের সুরক্ষার গুরুত্ব বোঝায়।

Step 4: ব্রতের দ্বিধা ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি 🕉️

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রতকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন: শাস্ত্রীয় ব্রত ও মেয়েলি ব্রত। শাস্ত্রীয় ব্রতগুলোতে নিয়ম-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান থাকে, যেখানে মেয়েলি ব্রত সাধারণত নারীদের দ্বারা পালন করা হয় এবং এতে তেমন নিয়ম থাকে না।

তিনি বলেন, ব্রত মানেই কোনো না কোনো কামনা বা চাওয়া। ঈশ্বরের দর্শন পাওয়ার ইচ্ছাও একটি কামনা। নিষ্কাম ইচ্ছা বা কামনা সম্ভব নয়। তাই ব্রত মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ।

ষষ্ঠী ব্রতও এর বাইরে নয়, এটি মূলত মা ষষ্ঠীর প্রতি ভক্তি ও সন্তানের সুস্থতা কামনার জন্য পালন করা হয়।

Step 5: ষষ্ঠী দেবীর বৈদিক ও পৌরাণিক পরিচয় 🌿

ষষ্ঠী দেবী ১৬ জন মাতৃকার একজন এবং দেবসেনা নামে পরিচিত, যিনি কার্তিকের পবিত্র ও প্রিয়তম স্ত্রী। শিবপুরাণ অনুযায়ী, মার্গশীর্ষ মাসের ষষ্ঠীতে শিবের পুত্র কার্তিকের জন্ম হয়। দেবী ভাগবত পুরাণে নারদ মুনি নারায়ণের কাছে মা ষষ্ঠী, মা চন্ডি ও মা মনসার বর্ণনা জানতে চান। নারায়ণ জানান যে প্রকৃতির ছয়টি অংশের ষষ্ঠ অংশ হল ষষ্ঠী, যিনি শিশুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

ষষ্ঠী দেবী বিষ্ণুর মায়া মায়া এবং সন্তানদের দীর্ঘায়ু ও সুরক্ষা প্রদান করেন। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতে ষষ্ঠী দেবীকে কাল্পনিক গ্রাম্য দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করেন।

Step 6: জামাই ষষ্ঠীর উৎসব ও এর সামাজিক প্রভাব 🎉

জৈষ্ঠ মাসের অরণ্য ষষ্ঠি পূজাকে বাংলায় জামাই ষষ্ঠী নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত অরণ্যে তৈরি তালপাতা, বটপাতা ইত্যাদি দিয়ে ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা করা হয়। পরে জামাইদের নিমন্ত্রণ এবং তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার রীতি যুক্ত হয়, যা কলকাতার বাবুরা চালু করেন।

জামাইকে পুত্রের মতো সম্মান জানানো হয়, নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয়, এবং পারিবারিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হয়। এটি মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিতির একটি সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।

পুরনো দিনে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি সুখের জায়গা ছিল না—বিশেষ করে সন্তান না থাকলে। জামাই ষষ্ঠী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্পর্কের পুনর্নবীকরণ ঘটত।

Step 7: বাংলা ক্যালেন্ডারে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ এবং জামাই ষষ্ঠীর স্থান 📅

  • বৈশাখ: নববর্ষ
  • জৈষ্ঠ: জামাই ষষ্ঠী (অরণ্য ষষ্ঠি)
  • আষাঢ়: রথযাত্রা
  • শ্রাবণ: মনসা পূজা
  • ভাদ্র: জন্মাষ্টমী ও বিশ্বকর্মা পূজা
  • আশ্বিন: দুর্গা পূজা
  • কার্তিক: ভাই ফোটা
  • অগ্রহায়ণ: নবান্ন
  • পৌষ: সংক্রান্তি
  • মাঘ: সরস্বতী পূজা
  • ফাল্গুন: দোল উৎসব
  • চৈত্র: চরক পূজা

এভাবেই বাংলার ১২ মাসে ১৩টি পার্বণ পালিত হয়, যার মধ্যে জামাই ষষ্ঠী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব।

Step 8: জামাই ষষ্ঠীর উৎসবের আধুনিক প্রেক্ষাপট এবং উপসংহার 🎊

আজকের দিনে জামাই ষষ্ঠী শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার একটি মাধ্যম। আধুনিক সমাজে মেয়েরা স্বাধীন ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও, এই উৎসবের মাধ্যমে পরিবারের মধ্যে আন্তরিকতা ও সম্পর্কের পুনর্নবীকরণ ঘটে।

শ্বশুর বাড়ি এবং মেয়ের বাড়ির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে জামাই ষষ্ঠী একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। জামাইদের এই অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে আসা, তাদের সম্মান প্রদর্শন, এবং পরিবারের আনন্দ ভাগাভাগি করা সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ।

অতএব, জামাই ষষ্ঠী শুধুমাত্র একটি লোকাচার নয়, এটি মা ষষ্ঠীর পূজা ও সন্তানের রক্ষার প্রতীক, যা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ) ❓

১. জামাই ষষ্ঠী কী?

জামাই ষষ্ঠী হল বাংলার একটি লোকাচার এবং পারিবারিক উৎসব, যেখানে জামাইদের সম্মান জানানো হয়। এটি মা ষষ্ঠীর পূজার সঙ্গে যুক্ত একটি অনুষ্ঠান।

২. মা ষষ্ঠী কে?

মা ষষ্ঠী হলেন প্রজনন এবং শিশুর রক্ষাকর্ত্রী দেবী, যিনি শিশুর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর জন্য পূজিত হন। তিনি ১৬ জন মাতৃকার একজন এবং দেবসেনা নামে পরিচিত।

৩. জামাই ষষ্ঠীর উৎসব কবে পালন করা হয়?

বাংলা ক্যালেন্ডারের জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে অরণ্য ষষ্ঠি বা জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয়।

৪. জামাই শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ কী?

অথর্ববেদে ‘জামি’ শব্দের অর্থ বোন হলেও ‘জামাত্রী’ শব্দের অর্থ জামাই। এটি কখনো স্বামী বা শালক অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে।

৫. জামাই ষষ্ঠী কেন গুরুত্বপুর্ন?

জামাই ষষ্ঠী সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুই পরিবারের সম্পর্ক মজবুত করার উৎসব। এটি মা ষষ্ঠীর পূজার সঙ্গে যুক্ত, যা শিশুর সুরক্ষা ও সুস্থতার প্রতীক।

৬. জামাই ষষ্ঠীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় সম্পর্ক আছে কি?

জামাই ষষ্ঠী মূলত একটি লোকাচার, যার সঙ্গে শাস্ত্রীয় সম্পর্ক খুব বেশি নেই। তবে মা ষষ্ঠীর পূজা শাস্ত্রীয় এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী।

৭. জামাই ষষ্ঠীর ইতিহাস কী?

জামাই ষষ্ঠী মূলত অরণ্য ষষ্ঠির সঙ্গে যুক্ত। কলকাতার বাবুরা ১৮শ শতকে জামাইদের নিমন্ত্রণ এবং খাওয়া-দাওয়া চালু করেন। শিবপুরাণ, মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণে জামাই ও মা ষষ্ঠীর উল্লেখ আছে।

৮. মা ষষ্ঠীর বাহন কী?

মা ষষ্ঠীর বাহন কালো বেড়াল, যা প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত।

৯. জামাই ষষ্ঠীর সময় জামাইদের কী কী দেওয়া হয়?

জামাইদের খাওয়াদাওয়া, নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় এবং তাদের বিশেষ সম্মান জানানো হয়।

১০. জামাই ষষ্ঠী পালন করার পেছনে সামাজিক কারণ কী?

পুরনো দিনে মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে থাকা কঠিন ছিল। এই উৎসব মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে আসার সুযোগ দেয়, এবং দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে।

Free Stuff!

Check out this really cool thing

Click me

জামাই ষষ্ঠী উৎসবের শাস্ত্রীয় ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, মা ষষ্ঠী দেবীর পূজা, লোকগল্প ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। বাংলার পারিবারিক সংস্কৃতিতে এই উৎসবের অনন্য স্থান।

তথ্যসূত্র